টাঙ্গাইলে শীতের রাতে আলোকিত ব্যাডমিন্টন খেলা
শীতে যেমন লেপ প্রধান অনুষঙ্গ তেমনি আরও এক অনুষঙ্গ হলো ব্যাডমিন্টন। শীতের হিমেল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ব্যাডমিন্টন কোর্টে এসে একবার হাতে র্যাকেট উঠিয়ে শুরু করলে পারলেই হলো। কোথায় যায় শীত, কোথায় যায় জড়তা!
আমাদের দেশে দিনকে দিন শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন খেলার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
অথচ আশি দশকের বিকেল বেলায় এই ব্যাডমিন্টন খেলার প্রচলন ছিলো। ব্যয় বহুল বলে সবাই তখন এই খেলা খেলতে পারতো না, উচ্চ বিত্ত ঘরের ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে মধ্যবিত্তের কিছু ছেলেরা খেলতো। রাতের বেলা বৈদ্যুতিক আলোতে এই খেলা খেলতে দেখা যেতো না।
আর এখন সূর্যের তেজ ধীরে ধীরে কমতে শুরুলে ঠিক তখনই হিমেল হাওয়া গায়ে মাখিয়ে উষ্ণতার খোঁজে কাঁপতে কাঁপতে সকলে চলে আসে নিজেদের তৈরি করা কোর্টে। দুপাশে বাঁশের সঙ্গে বোর্ড ঝুলিয়ে লাগানো, ডজন খানেক লাইটের উজ্জল আলোতে র্যাকেট এবং শাটল কর্কের ঠাশ ঠাশ শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ। শুরু হয় ব্যাডমিন্টন খেলা আসল আমেজ। ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী,বৃদ্ধসহ সকলেই যেন খেলায় আনন্দে মেতে উঠে। মাঠ, গলিতে একটু ফাঁকা স্থান পেলেই ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য কোর্ট তৈরী করা যায়।
কোনো এককালের উচ্চবিত্তের খেলা এখন চাকচিক্যের চৌহদ্দি পেরিয়ে চলে এসেছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষের মাঝে। ব্যাডমিন্টন খেলার সূত্রপাত ঘটে আজ থেকে প্রায় শোয়াসো বছর পূর্বে। ইংল্যান্ডের গ্লুচেষ্টারশায়ার রাজ্যেও ব্যাডমিন্টন নামক গ্রামের ব্যাটেরডোর হলে ১৮৭৩ সালের এক বৃষ্টিভেজা দিনে এ খেলা হয়।
এরপর থেকে এখানে নিয়মিত খেলা হত এবং উৎসক দর্শকরা আগ্রহ সহকারে এই খেলা উপভোগ করত। এভাবে ধীরে ধীরে খেলাটি বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এদিকে বৃষ্টি ভেজা দিনের খেলা হিসেবে ব্যাডমিন্টন এর যাত্রা শুরু হলেও, বর্তমানে শীত আগমনের অন্যরকম এক বার্তা বয়ে আনে এই ব্যাডমিন্টন খেলা।
ব্যাডমিন্টন খেলা শহরাঞ্চলেই এই খেলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী। আর শহরের মধ্যে আবার বেশি খেলে ছাত্ররা। ঝামেলাহীন এবং অল্প পরিসরে এর আয়োজন সম্ভব বলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এর পরিধি। আর তাইতো শীতকাল এলেই ব্যাডমিন্টন খেলার ধুম পড়ে যায় সারা দেশে। শহরের পৌর উদ্যান, উপজেলা মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম, সার্কিট হাউজ মাঠ, হাউজিং মাঠসহ বিভিন্ন মহল্লার ছোট জায়গা ব্যাডমিন্টন খেলার আলোতে ছেয়ে গেছে।
ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষার শেষের পথে। ওরাও অপেক্ষায়, পরীক্ষা শেষে হাতে তুলে নিবে দামী র্যাকেট। এদিকে শীতের শুরুতে টাঙ্গাইল সদরের ছিলিমপুর ইউনিয়নে মরহুম মাগন মেম্বারের বাড়ির সামনে নয়াপাড়া ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের ফাইনাল জামজমক ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ব্যাডমিন্টন খেলা কিছু নিয়ম আছে, মোট পাঁচটি পদ্ধতিতে ব্যাডমিন্টন খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে; পুরুষ একক, মহিলা একক, পুরুষ দ্বৈত, মহিলা দ্বৈত ও মিশ্র। খেলার শুরুতে টসে বিজয়ী দল বা খেলোয়াড় পছন্দমতো কোর্ট নিতে পারবে বা প্রথমে সার্ভিস করতে পারবে। একক ও দ্বৈত খেলায় ২১ পয়েন্টের মোট তিনটি গেম অনুষ্ঠিত হয়ে। খেলায় যদি ডিউজ বা পয়েন্ট সমান হয় তাহলে খেলা ৩০ পয়েন্টে চলে যায়। সার্ভিস করার সময় শাটল নেটে স্পর্শ করে প্রতিপক্ষের কোর্টে পৌছালে সার্ভিস সঠিক হিসেবে গন্য হয়।
শাটল যে সাইটের কোর্টে পড়ে তার বিপরীত সাইট পয়েন্ট পায়। একক খেলায় সার্ভিসকারীর পয়েন্ট শুন্য বা জোড় হলে খেলোয়াড় ডান দিকের কোর্ট থেকে এবং বিজোড় হলে বাম দিকের কোট থেকে সার্ভিস শুরু করবে। সার্ভাও একটি র্যালি জিতলে এক পয়েন্ট পাবে এবং কোর্ট বদল করে সার্ভ করবে। সার্ভিস করার সময় সার্ভারের দুই পা অবশ্যই মাটিতে স্পর্শ করা অবস্থায় থাকতে হয়। নেট অতিক্রম করে কোনো খেলোয়াড় শাটলে আঘাত করতে পারবে না এবং খেলা চলাকালে কেউ র্যাকেট বা শরীরের কোনো অংশ দিয়ে নেট স্পর্শ করতে পারবে না।
আমার দৈনিক মজলুমের কন্ঠ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জাফর আহমেদের কথামত সন্ধ্যে নামার পর টাঙ্গাইল শহরে ব্যাডমিন্টন খেলা দৃশ্য নিয়ে লেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। শীতের রাতে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবমুখী কাজী নজরুল সড়কের চমৎকার আলো দেখতে দেখতে যখন পেরিয়ে যাচ্ছি । তখনই চোখে পড়লো পৌর উদ্যানের খেলার মাঠ। রাত তখন ১০টা । কিন্তু রাতের নিস্তবদ্ধতা থমকে দিয়ে এখানে চলছে ব্যাডমিন্টনের জমকালো আয়োজন। মোট ২টি কোর্টে পুরোদমে খেলা চলছে। টাঙ্গাইলের সেরা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দের স্থান উপজেলা মাঠে চলে এলাম। এখানে পুরো মাঠই আলোকিত হয়ে আছে হ্যালোজেনের আলোয়। উৎসবমুখর পরিবেশে ওরা আনন্দের সাথে চমৎকার ব্যাডমিন্টন খেলছে।
টাঙ্গাইল সদরের উপজেলা খেলার মাঠে কথা হয় টাঙ্গাইল ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের সেরা একজন খেলোয়াড় ফরিদুল ইসলাম মিল্টনের সাথে। তিনি বলেন, আমরা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ব্যাডমিন্টন গ্রাউন্ডে সারা বছর ব্যাডমিন্টন অনুশীলন করে থাকি। মাঝে মাঝে এখানে অনেক জাতীয় পর্যায়ে নামিদামী খেলোয়াড় এসে আমাদের সাথে অনুশীলন করে। টাঙ্গাইলের একটি মাঠে সবসময় অনুশীলন চলে, সেটা উপজেলা মাঠ। এই মাঠের খেলোয়াড়ই টাঙ্গাইলের সর্বোচ্চ ভালো মানের খেলোয়াড়। ক্রীড়ামোদী দর্শকদের আহবান জানাবো খেলতে আসার এবং দেখার। এই মুর্হুতে মাঠটিও সংস্কার উন্নত মানের পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
তবে শুধু যে খেলোয়াররাই আছে তা নয় সঙ্গে রয়েছে দর্শক ছাত্ররাও। যারা উৎসাহ আর গল্পে গল্পে মাতিয়ে রেখেছে শীতের হিমেল রাতকে। একদলের খেলা শেষ হতেই সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে আরেক দল খেলার জন্য। কখনো হোপ বাই নীল, আবার কখনও হোপ বাই টেন শব্দে মুখরিত খেলার মাঠ।
বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী এরশাদ বলেন, আমরা কোর্ট কাটছি। র্যাকেট-ট্যাকেট, নেট-টে সব কিনা হইছে। মাঠে কোর্ট কাটা হইছে। আর শীতকালে এইটা আমাদের অনেক ইমপরট্যান্ট একটা খেলা। শিমরোজ নামে এক কিশোর ছাত্র বলে, এইটা তো শীতকালীন খেলা। খেলতে আমাদের খুব ভালো লাগে, তাই আমরাও খেলি।
শুধু খেলোয়ারই নয়, খেলা দেখে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে দেখা গেলো চাকুরিজীবি শাহ এমদাদুল আহমেদ বাচ্চুর সাথে। উচ্ছসিত বাচ্চু বলেন, সারাদিন সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে এই খেলাকে কেন্দ্র করে আমরা একত্র হই। আমার পায়ে সমস্যা তাই খেলতে পারি না, তবে খেলা দেখতে ভালোবাসি। সে জন্য আমরা সবাই খুব মজা করি।
খেলোয়াড়রা জানালেন তাদের খেলার সরঞ্জাম সবই নিজেদের অর্থের। সবাই সমপরিমান চাঁদা দিয়ে এই খেলার আয়োজন করেন। প্রতি রাতে, কিংবা প্রতি গেমে একটা একটা কর্ক বা ফেদ্যার নষ্ট হলো পাল্টাতে হয়। প্রতিটি কর্কের দাম ১০০ টাকা।
টাঙ্গাইল খেলাধূলার দোকান ঘুরে জানা গেছে, তাদের কয়েকজনের কথা এরকম, আগের দিনের তুলনায় এখন ব্যাডমিন্টন খেলা কমে গেছে। যে কারনে বিক্রি কম ।
এই খেলাটি শীত মৌসুমের খেলা। কিছু খেলোয়াড় শীতের শেষ পর্যন্ত খেলবে। ছাত্রছাত্রীরা বার্ষিক পরীক্ষার পর ১৫ থেকে ২০ দিনে সময়ে ব্যাডমিন্টন খেলবে। তারপরই বছরের শুরুতে নতুন শ্রেনীতে উঠে পড়াশোনায় মনোযাগী হবে। নিত্য নতুন বাড়ীঘর তৈরী হওয়ায় ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ কমে এসেছে। এছাড়া মোবাইলের কারনে ছাত্রছাত্রীরা ঘরে কিংবা খেলার মাঠে বসে গেমস খেলে বেড়ায়। এসব কারনে খেলাধূলার সরঞ্জাম কেনার চাহিদা কম। তারপরও ভালো কিছুর আশায় তারা দোকানে বসে থাকে।
কিন্তু এতো কিছুর পরও কিন্তু থেমে নেই ব্যাডমিন্টন খেলা। স্বাস্থ্যসম্মত এই খেলা খেলতে দেখা যায় চল্লিশোর্ধ মানুষদের। যারা স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তারা প্রতিনিয়ত রাতের বেলা এবং শীতের সকালে দেখা যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে। কথা হলো চল্লিশোর্ধ ব্যবসায়ী হীরা মার্কেটের কর্নধার মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের সাথে, শীতের রাতের হিম জড়তাকে সড়িয়ে দিয়ে তিনি জানালেন কিছু কথা। তিনি বলেন, শীতের রাতে ঠান্ডা থেকে শরীর গরম করার জন্য আমরা প্রতি বছর এই খেলার আয়োজন করে থাকি। তাছাড়া শীতকাল হল ব্যাডমিন্টন খেলার মৌসুম। সে জন্য সবাই এক সময় ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য প্রস্তুত থাকি।
রাতের নিস্তবদ্ধতা গ্রাস করে করে ফেলে র্যাকেট আর ফেদারের শব্দে। তবু এই চিত্র কিন্তু পুরো শহর জুরেই নয়। কোথাও গিয়ে আবার শুনতে হয় নানা অভিযোগ। যেমন ধরা যাক রাতের বেলায় ব্যাডমিন্টন খেলার শব্দে অনেকেরই ঘুমের ব্যাঘাত কিংবা মনোযোগী ছাত্রের পড়ালেখার ব্যাঘাত।
জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা আফাজ উদ্দিন বলেন, ব্যাডমিন্টন একটি জনপ্রিয় স্বাস্থ্যসম্মত খেলা। এই খেলা বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েরা খেলতে পারে। খেলতে পারে বয়স্ক ব্যাক্তিরাও। ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াই লক্ষ্য। প্রতিবারের ন্যায় এবারও জমজমাট টুর্নামেন্ট আয়োজনের চিন্তা ভাবনা আছে।
এম.কন্ঠ/ ১২ ডিসেম্বর /এম.টি