দেলদুয়ারে শীতল পাটির কদর সারা দেশে
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সিলেটের ঐহিত্যবাহী শীতল পাটি মোগল শাসনামলে সাম্রাট আওরঙজেব এবং ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে উপটৌকন হিসেবে গিয়েছিল এবং রাজ রাজারা যারপরনাই প্রীত হয়েছিলেন। আবহমান বাংলায় যুগ যুগ ধরে মানুষের ঘরে ঘরে সেই শীতল পাটির চাহিদা তখনও ছিল, প্লাস্টিকের ম্যাট আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আধুনিক যুগেও চাহিদা কমে গেলেও ঐহিত্য নিয়ে টিকে আছে।
সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার সুন্দর মনোরম হিংগানগর গ্রামে ৬০০ থেকে ৭০০ পরিবারের মাঝে শীতল পাটির কারিগররা বেঁচে আছেন। দূর অঞ্চলের কাছে ‘ পাটির গ্রাম’ নামে পরিচিত এই হিংসানগর গ্রাম। সরেজমিনে জানা যায়’ হিংগানগর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বংশ পরস্পরায় শীতল পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এই কাজে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না দেখে এখন তাদের ছেলেরা পড়ালেখা করে চাকরীজীবি পেশায় অভ্যস্থ হওয়ার চেষ্টায় আছে।
শীতল পাটি ঐহিত্যবাহী গৃহায়নের কারুশিল্প। দেশে পাটিপাতা চাষ পরিবেশবান্ধব, জলবায়ু সহায়ক। শীতল পাটির প্রধান উপাদান হলো মোরতা। এটি এক প্রকারের নলখাগড়া জাতীয় ঘাস। অঞ্চল ভেদে কোথাও মোরতাকে হারিযাতা গাছ, মোস্তাক আবার কোথাও পাটিগাছ বা পাইত্রা গাছ বলা হয়ে থাকে। এ গাছ ছোঁপ-ঝাঁড়ে, জঙ্গলে, জলাশয়, রাস্তার ধারে, পাহাড়ের পদতলে আপনা আপনি জন্মে। তবে এখন পাটির জন্য এ গাছ চাষ করা হয়। এ গাছ পরিপূন হতে ২ বছর লাগে। দুই বছর পর গাছ কেটে, সেখানে নতুন করে আবারও গাছ লাগানো হয়।
পাটি তৈরী করতে প্রথমে জঙ্গল থেকে এ মোরতা গাছ কেটে প্রথমে ছাঁটা হয়। তারপর প্রতিটি মোরতা বটি বা ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে কেটে নিপুণ তাতে বেতি তৈরি করে ভাতের মাড়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে ভাতের মাড় ও পানির মিশ্রণে সেগুলো সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ বেত পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে শুরু হয় পাটি বোনার কাজ। মোরতার উপরিভাগ দিয়ে বানানো হয় মসৃণ এ শীতল পাটি।
শিল্পীর হাতের ছোঁছায় ফুটে উঠে বর্ণিল ফুল, ফল, পশুপাখি প্রিয়জনের অবয়ব এমনকি জ্যামিতিক গাণিতিক নকশাও। শীতল পাটির নকশায় জায়নামাজে ব্যবহৃত হয়েছে মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা। এ শীতল পাটিকে ঘিরে যুগে যুগে কত গান, কত কাব্য রচিত হয়েছে তার হিসেব নেই।
পল্লী কবি জসিম উদ্দিন তার লেখা ‘ নকশীকাঁথার মাঠ” কাব্যগ্রস্থ কামরাঙা নামক শীতল পাটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে“ আসুক আসুক মেয়ের জামাই, কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছাই থুইছি, কামরাঙা পাটি নারে” আগের দিনে যখন বিদ্যুৎ ছিল না, তখন কাঁথা বা তোষকের ওপর মিহি বেতের নকশি করা এক ধরনের পাটি ব্যবহার হতো। তাতে গা এলিয়ে দিলে শরীর বা মনে শীতল পরশ অনুভূত হতো। তাই তখনই জ্ঞানীরা এই পাটির নাম দেন শীতল পাটি।
ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বাইরের চেয়ে কম তাই তাই শীতল পাটিটা নিয়ে ঘরের মেঝেতে কিংবা ঘরের পাশে কোন গাছের ছায়ায় বসি। শীতল পাটির শীতল ছোঁয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে আসবে, গরম থাকলে চোখে ঘুম চলে আসবে।
শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ^ ঐতিহ্যেরও অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক এ স্বীকৃতি ঘোষণা দিয়েছে।
হিংগানগর গ্রামের রামকুমার নন্দীর ছেলে পুষ নন্দী বলেন, বংশগত পর্যায়ে আসেন শীতল পাটি তৈরী পেশায়। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমাদের বাপ-দাদা ও তার পূর্বপুরুষেরা এ পেশায় জড়িত। আমরা সবাই এ পেশার ওপর নির্ভরশীল। চাচারাও এ পেশায় জড়িত। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার হিংগানগর গ্রামে কামনায় পাটির হাট বসে। নানা স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে পাটি কিনেন। আমরা হাটে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করি। তিনি আরো বলেন, আমাদের এ পেশায় ভ্যাগের পরিবর্তন না হওয়ায় আমার ছেলে এ পেশায় আসবে না। এক ছেলে পড়ালেখা চাকরী করছে আর অন্য ছেলে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে।
কালি নন্দীর ছেলে ৬২ বছর বয়সী খুশী নন্দী বলেন, শীতল পাটি তৈরীর কারিগর দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে শীতল পাটির উপকরণ মোরতা কিনতে সাধারণ টাকা লাগত না। তার কারণ এগুলো আগাছার মতো যেখানে সেখানে জন্মাত। কারিগররা সেগুলো সংগ্রহ করে পাটি বুনত। শুধু সময় ও পরিশ্রমের দাম হিসেবে এগুলোর মূল্য নির্ধারন হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে মোরতা কিনে নিতে হচ্ছে। কারণ মোরতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
কালিহাতী উপজেলার আউলটিয়া গ্রামের জ্যোতি চন্দ্র দাসের মেয়ে শিল্পী নন্দীর বিয়ে হয়েছে হিংগানগর গ্রামের উজ্জল নন্দীর সাথে। তিনি ছোট বেলা থেকে বাবার কাছ থেকে পাটি তৈরী শিখে , শ^শুরবাড়ীতে এসেও পাটি তৈরী করছেন। তিনি বলেন’ প্রতিটি পাটি তৈরী করতে দুই দিন সময় লাগে। যে পরিমান পরিশ্রম সে পরিমান মজুরি পান না। প্রায় ২০ বছর যাবত এ পাটি তৈরি করছেন। তিনি আরো বলেন, নকশা করা শীতল পাটি অনরকম চাহিদা আছে, তাই রঙ করে মোরতা শুকিয়ে বিভিন্ন নকশা করিয়ে পাটি বানালে তা দেখতে সুন্দর এবং মানে ভালো হয়। এগুলোর দামও বেশী। বর্তমানে ৫ থেকে ৭ ফুট পাটি ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা দাম। এছাড়া ছোট আকারের পাটি হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
মোরতা গাছ বা বেত বাগানের মালিক সৃদাম চন্দ্র দে বলেন, একটা বেদ বড় হতে তিন বছর লাগে। বেদ পরিপূর্ন হলে বেদ কাটার পর সেখানে আবারও ছোট বেতের চারা লাগান। এভাবে তিনি পাটি তৈরীর ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি নিজেও শীতল পাটি তৈরী করেন।
মৃত্তিকা রানী নন্দী বলেন, শীতলপাটি শিল্পটি এখন মহাজনের ওপর নির্ভরশীল। মহাজনেরা মোরতা জঙ্গল ইজারা নেয় এবং অতি বেশী মূল্যে কারিগরদের কাছে বিক্রি করে। অনেক সময় দাদনও দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের অন্যান্য হস্থশিল্পের মতোই এ শিল্পের শিল্পীরা দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকারের অন্যান্য শিল্পের মতো শিল্পের দিকে একটু নজর দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
আমাদের দেশে পাটির রয়েছে নানা ধরনের নাম ও ব্যবহার। শুধু শয্যা বা বসার জন্য নয়; বিদ্যুতের পাখার অবর্তমানে অতীতে জমিদার বাড়ি ও সরকারি অফিস আদালতে শীতল পাটির মাদুর দিয়ে টানা পাখার ব্যবহার ছিল। আজকাল এ শীতল পাটি শুধু বিছানায় ব্যবহার হয় না, বরং রুচিসম্মত সাজসজ্জারর উপকরণ, বাতির জন্য শেড, কার্পেটের বদলে নকমী মাদুর, খাওয়ার টেবিলে চোট আকারের নকশী ম্যাট, চশমার খাপ, সুকেস, ব্যাগ, দেয়াল হ্যাঙ্গার ইত্যাদি শীতল পাটির বহুল চাহিদা রয়েছে। শীতল পাটিকে চিত্তাকর্ষনীয় করার জন্য বিভিন্ন ডিজাইন ও মোটিভ ব্যবহার করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের উপকরণ হিসেবে শীতল পাটি ব্যবহার হয়ে আসছে বহুযুগ ধরে। অতীতে গ্রামাঞ্চলে বিয়ে বাড়ী ছাড়া বিভিন্ন দাওয়াতে শীতল পাটি উপহার হিসেবে ব্যবহত হয়ে আসছে। যা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
কালিহাতী থেকে আগত মহাজন জ্যেতি চন্দ্র দাস বলেন,বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহরে আগের মতো শীতল পাটির চাহিদা নেই, প্লাষ্ট্রিকের ম্যাট, বৈদ্যুতিক পাখা কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রনের যুগে শীতল পাটি চাহিদা একটু কমবেই, এটা ধরে নিতেই হবে। তারপরও ঐহিত্যময় র শীতল পাটি তৈরী থেমে থাকবে না। একটি শীতল পাটি তৈরী করতে কারিগরদের ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হয়ে। এছাড়া পাটি তৈরীতে বেত কেনা সহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। পাটি বাজারজাতকরনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা না থাকায় বানিজ্যিক ব্যাংক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন বলে জানান। তারপরও শীতল পাটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের চাহিদাও পুরণ করছে এবং আগামীতেও করবে।
এম.কন্ঠ/ ১৬ মে /এম.টি