টাঙ্গাইলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মাহমুদনগরে ধলেশ্বরী সেতু অতীব প্রয়োজন
“চীনের দুঃখ হুয়াংহো আর মাহমুদনগরবাসীর দুঃখ ধলেশ্বরী” বড্ড আপেক্ষ নিয়ে কথাটি বলেছিলেন মাহমুদনগর এলাকার সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাবেক ছাত্রনেতা রিফাতুল ইসলাম রিপন।
ধূলোমাখা সূর্যের তাপে ফুটন্ত বালুর সমুদ্রে এক কিলোমিটার হেঁটে ধলেশ্বরী নদী পাড় হওয়ার কষ্ট! যাকে পাড় হতে হয়, তিনিই বুঝেন এই কষ্টের কথা! আর বর্ষাকালে ভরা বন্যায় খেয়াঘাট পাড় হতে গিয়ে খেয়া মিস করে জীবনের মূল্যবান ধাপ চাকুরী কিংবা পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা, সেটা এই মাহমুদনগর চরবাসীই ভাল অনুভব করতে পারেন! জীবনের পরীক্ষায় এটা নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গেছে। জরুরি অসুস্থ রোগীকে সদর হাসপাতালে নেওয়ার সময় কত জীবন অকালে হারিয়েছে! কেবলমাত্র একটা সেতুর অভাবে মাহমুদনগর ইউনিয়নের চরবাসীকে অনেককাল অবহেলিত থাকতে হয়েছে, কিন্তু আর কত? কষ্টের জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে ধলেশ^রী নদীতে “মাহমুদনগর সেতু” নির্মাণের দাবী জানান।
টাঙ্গাইল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় ২৪টি গ্রাম নিয়ে ৩০ হাজার জনসাধারনের বিচ্ছিন্ন স্বর্ণদ্বীপ মাহমুদনগর ইউনিয়ন স্থাপিত হয় ২০০৪ সালে। আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। পরিবারের সংখ্যা ৪২০০টি। একটি ডাকঘর। এই অঞ্চলের শিক্ষার হার ৭০.৫%. প্রধান পেশা প্রবাসী আয় ও কৃষি। আবাদী জমির পরিমাণ ৫১২৫ একর। জলধারা ২২টি। বিল রয়েছে ১৫টি। সোনার ফসল উৎপন্ন হওয়া এই এলাকাটি ২০০৪ সাল পর্যন্ত কাতুলী ইউনিয়নের অর্ন্তগত ছিলো। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের জন্মস্থান এই মাহমুদনগর ইউনিয়নের মাকোরকোল গ্রামে। যে কারনে মাহমুদনগর ইউনিয়নে যাতায়াতে পাকা রাস্তার দেখা মেলে। কিন্তু গোলচত্তরের পর ধলেশ্বরী সেতু না থাকায় শুকনো মৌসুমে প্রায় এক কিলোমিটার পথ তপ্ত বালু পথে হেঁটে পাড় হতে হয়। বর্ষাকালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হওয়ার যন্ত্রনা শেষ হওয়ার নয়। মাহমুদনগর ইউনিয়নের ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবিসহ সিরাজগঞ্জের চৌহালী, নাগরপুরের ভাড়রা ইউনিয়নের পশ্চিম অংশের হাজার হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তা এটি।
মাহমুদনগর ইউনিয়নের গ্রামগুলির মাটি অত্যন্ত উর্বর।সেখানে ধান, পাট,গমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়ে থাকে। আর নদীতে পাওয়া যায় টাটকা মাছ। মাহমুদনগর ও তার আশেপাশে রয়েছে অনেকগুলি হাট। বিখ্যাত শাহ্জানী, করিমগঞ্জ,বালিয়াপাড়া, চাঁনবয়রা, কাতুলি এদের মধ্যে অন্যতম। এই হাটে গ্রামের মানুষ ছাড়াও শহরের মানুষ অল্প খরচে বাজার করতে যান।
মাহমুদনগর ইউনিয়নে মেজর মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয় ও বালিয়াপড়া উচ্চ বিদ্যালয় নামে ২টি মাধ্যমিক স্কুল, একটি পূর্ণাঙ্গ সতন্ত্র কারিগরি স্কুল, ১০টি প্রাইমারী স্কুল,১টি ফাজিল ও একাধিক হাফিজিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। মানুষের সাময়িক বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে রয়েছে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহমুদুল হাসানের বাড়ী ছাড়াও অনেক খ্যাতিমান মানুষের বাস এই এলাকায়। একসময়ের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল করিম তালুকদার ও নির্লোভ ব্যাক্তিত্ব মরহুম রজব আলী সরকার এই এলাকারই মানুষ ছিলেন।
জনতা ব্যাংকের টাঙ্গাইল কর্পোরেট শাখার এজিএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ধলেশ্বরী সেতু না থাকায় আমাদের সমস্যার অন্ত নাই। আমাদের এখানে কৃষকের উৎপাদিত সব পন্য শহরে বিক্রি হয়। সীমাহীন কষ্ট ও অধিক ব্যয়ে ঘোড়াগাড়ীতে করে শহওে পণ্য পরিবহন করা হয়। এছাড়া আমরা নিয়মিত যাতায়াত করি।ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা যাতায়াত করে। নদীতে খেয়া মিস করে অনেক প্রবাসী ভাইয়ের ফ্লাইট মিস করার বহু নজির এলাকায় রয়েছে। প্রসুতি মায়ের উন্নত চিকিৎসার্থে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নেওয়া যায় না। অনেক সময় এই নদীতেই সন্তান ভূমিষ্ট হয়। আবার জরুরী রোগী নদী পাড় হতে দেরী হওয়ায় এখান্ইে মারা গেছেন। এই পথ দিয়ে সিরাজগঞ্জের চৌহালী, নাগরপুরের ভাড়রা ইউনিয়নের শাহজানী, কাতুলী ইউনিয়নসহ শহরের মানুষ এই পথে যাতায়াত করে। এলাকার দুজন বড় নেতা তুলনামূলক অল্প দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তারা এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। সেতুর কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি। যারাই এই নগরে আসেন, ভোটের আশায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। ভোটের পর ভোট যায়। সেতুর কাজ আলোর দেখা পায়না। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এই মুহুর্তে ধলেশ্বরী সেতু হওয়াটা খুবই জরুরী।
কৃষক মুন্নাফ আলীও আব্দুল জব্বার আলী বলেন, পণ্যদ্রব্য চাষ করে নিয়মিত বিক্রয়ের জন্য সময়মতো বাজারে নিতে পারি না। অনেক খরচ পরে। সময়ও লাগে বেশ। শহরে পণ্য বিক্রি করে তাই আমাদের পোষায়না। গ্রামেও বিক্রি করতে পারিনা। কৃষিকাজে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। সেতুটি হলে আমাদের অনেক উপকার হবে।
মেজর মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্রী শান্তা আক্তার বলেন, বর্ষাকালে নৌকায় আর বাকী সময় ধূলিমাখা বালু পথে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। এখানে নদীর উপর সেতু হলে আমরা খুবই উপকৃত হবো।
ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, বর্ষাকালে নদী পথে নৌকায় ভ্যান উঠানো আবার বাকী সময়ে বালুপথে ভ্যান চালানো খুবই কষ্টকর। এখানে ধলেম্বরী সেতু হলে আমরা খুবই উপকৃত হবো।
খেয়াঘাটে প্রায় ২৬ বছর যাবত সোবহান ইজারাদার হিসেবে আছেন। তারও দাবী ধলেশ্বরী নদীর উপর সেতু হলে অনেক কষ্ট লাঘব হবে। তিনি জানান, নদী পাড় হতে মোটরসাইকেলে ১০ টাকা, সিএনজি, প্রাইভেট কারে ৩০টাকা হলেও বেশিরভাগই ৫/১০ টাকা দিয়ে যায়। আবার অনেকে টাকা না দিয়েই চলে যান। অথচ বছরে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা ইজারা দিতে হয়।
সুবর্নতলীর আমির মোল্লা, কুকুরিয়ার কামরুল, শাহজানীর শফিকুল, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুর রহমান ও মাকোরকোল এলাকার রাওয়ান বিবির সাথে কথায় জানা গেছে ধলেশ্বরী সেতুটি এখন অতীব প্রয়োজন। এটা হলে পশ্চিম টাঙ্গাইলের অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হবে।
এলজিইডি’র প্রকৌশলী ইবাদত আলী বলেন, ধলেশ্বরী সেতু নিয়ে আলোচনা ও মাপযোগ হয়েছে। প্রায় ১ কিলোমিটার ধলেশ্বরী সেতুটি নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো হবে। আমরা বড় বাজেটের অপেক্ষায় আছি। বড় বাজেট পেলেই ধলেশ্বরী সেতুটি নির্মাণ কাজ করা সম্ভব।
মাহমুদনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসলাম শিকদার বলেন, আমাদের গ্রামের অভিভাবক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান ২০০৮ সালের সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সেতুটির টেন্ডার পাশ হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। মাহমুদনগর সেতুটি উন্নয়নের স্বার্থে, দেশের মানুষের কষ্ট লাঘবে স্বার্থে জরুরী ভাবে নিমার্ণ করা দরকার। মাহমুদনগরবাসীর দাবী আমাদের অভিভাবক মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান সাহেবের নামে সেতুটি নিমার্ণ করা হউক।
এম.কন্ঠ/ ০৩ মার্চ /এম.টি