“জাতীয় সঙ্গীতের পোস্টমর্টেম; ভূমিকায় ডাক্তার নাকি ডোম?”
“আমার সোনার বাংলা ” গানটি বর্তমানে টক অব দ্য কান্ট্রি। ফেসবুকপাড়া ব্যস্ত এর সুরৎহালে। ২/১ জন বাদে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি মহলের যেমন কোনো রা নেই তেমনি দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদেরও দৃশ্যত কোনো মন্তব্য নেই। তবে বর্তমান সরকারের কেও কেও মন্তব্য করলেও কারো কথায় পরিবর্তনের কোনো আঁচ পাওয়া যায়নি।
তাহলে প্রভাবকের ভূমিকায় কারা? কারা হেশেলে ফু দিয়ে দিয়ে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা গরম করতে চাইছে, প্রশ্ন নানা মহলের। আমার মতে সঙ্গীতটির সুরৎহালে ব্যস্ত একপাল ডোম, যাদের গুরু স্বয়ং গোয়েববলস। অথচ দেশের মারাত্মক স্পর্শকাতর এ বিষয়টিতে যেসব বুদ্ধিজীবি-রাজনীতিকের ডাক্তারের ভূমিকায় থাকার কথা তাদের কেও-ই নেই।
এদের একটি দল যেমন যৌক্তিক দলিল ছাড়াই শিরক-বিদআতের কথা বলে জাতীয় সঙ্গীতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে তেমনি আরেকদল দেশকে মাতা হিসেবে মানার বিপরীতে মা-কালি ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে। এদের কাছে প্রশ্ন করলেও কোনো সদুত্তর নেই। গোয়েববলসের মতো গুঁজামিলে ঠাসা। এরা অনেকের কাছে মৌলবাদী হিসেবেই পরিচিত। তবে মৌলবাদের সংজ্ঞাটা আবার ভিন্ন। আজ সে প্রসঙ্গে যাব না। শুধু এটুকু বলে রাখি, মৌলবাদ শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়,প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে।
একসময় উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। সতীকে জীবন্ত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বিধাতার কাছে জোরপূর্বক পুরো জাতকূলের স্বর্গ নিশ্চিত করতে চাইতো। যখন এর বিরুদ্ধে উপমহাদেশে প্রতিবাদ সংগ্রাম হয়, তখন জাগরিত জনতাকে হিন্দু মৌলবাদীরা কলিযুগের নিকৃষ্ট কীট অভিহিত করে তাদের হত্যা অত্যাবশ্যকীয় ও পূণ্যের কাজ বলে ফতোয়া ছাড়ে। উপমহাদেশে যখন মসজিদে-মসজিদে প্রথম আযানের প্রচলন হয়, তখন মৌলবাদী সম্প্রদায় বিদআত ও দুনিয়া ধ্বংসের আলামত হিসেবে একে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে।
‘৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ও এরাই “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলাকে “বউ তালাক হয়ে যাওয়ার সমতূল” ঘোষণা করে। আর বর্তমানের জাতীয় সঙ্গীতকে শিরকের আখড়া ফতোয়া দেওয়াকে কে কিভাবে দেখবেন তার বিচার আপনাদেরই। আমি একটু ডেফিনেশনের চেষ্টা করলাম মাত্র।
এখন আসি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে। অনেকে বলছে, রবি ঠাকুর বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেননি। কথাটা সত্য। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের বিপরীতে পুরো বাংলার অখন্ডতার প্রশ্নে ভাবাসিক্ত হয়ে “আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনা করেছিলেন যা তার দেশপ্রেমেরই পরিচায়ক। আর এটিই পরবর্তীতে জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। যখন তিনি এই গানটি রচনা করেন তখন বাংলাদেশতো দূরের কথা পাকিস্তান সৃষ্টির-ই ট্যামটেমি বাজেনি।
চিরায়ত অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে রচনাকৃত গানটি ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলন ও ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার উৎস। বর্তমান সরকারকে যেমন দেশের আপামর জনতা স্বাগত জানিয়েছে, তেমনি সেসময় “আমার সোনার বাংলা” গানটি সার্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছিল ও মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে পাকিস্তান শাসকবর্গ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি জোরপূর্বক আমাদের উপর চাপিয়ে দিলে রবিঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’, আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ প্রভৃতি গান আমাদের চেতনা ও সংগ্রামের উৎস হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রবিঠাকুরের উক্ত গানটি আমাদের প্রতিটি আন্দোলনের অন্যতম উজ্জীবক ছিল বলে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ১৩ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকে গাটির প্রথম ১০ চরণ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। গানটি বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত। এতে যেভাবে চিরায়ত বাংলা রূপায়িত হয়েছে তা অন্য কোন গানে হয়েছে কিনা কারো জানা নেই।
তাহলে রাষ্ট্র সংস্কারের নামে এসব কি? অল্প কিছুদিন হলো একটি সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সরকার অনেকটাই এলোমেলো। সবকিছু গোছাতে কিছুটা সময়ের দরকার। সেজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। ঠিক সে মূহুর্তে এরকম একটা স্পর্শকাতর বিষয় স্পষ্টত জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করছে।
বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙ্গার খবরও আসছে। বিষয়টিও মারাত্মক স্পর্শকাতর। কেননা এদেশে তরিকতপন্থি লোকেদেরও অভাব নেই। আবার কিছুদিন সারাদেশেই মন্দিরে মন্দিরে হামলার আশঙ্কায় এলাকাবাসী পাহারার ব্যবস্থা করেছে। দেশ এখনো অনেকটাই অরক্ষিত। এর মধ্যে এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিসরূপ।
এদেশ হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবারই। বাঙালি আউল-বাউল, ফকির-বৈষ্ণব, সহজিয়া-সুফিদের অভয়ারণ্য। এখানে সবাই মিলেমিশে দেশটাকে সমৃদ্ধ করেছে। একের মতবাদ অন্যের পছন্দ না-ই হতে পারে। পছন্দ না হলে এড়িয়ে চলা ভালো, কিন্তু তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার অধিকার কাওকে দেওয়া হয়নি। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কোনো পরিবর্তন না।
পরিবর্তনটা হবে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। একটা জিনিসের পরিবর্তন হবে পুরাতনের চেয়ে ভালোটা পাবার পর। জাতীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে আমরা সেটা পেয়েছি কিনা গভীর ভাবনার বিষয়। তবে সকল পরিবর্তনে জাতীয় আবেগের মূল্যায়নের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রাধান্য সর্বাগ্রে।
পাকিস্তান আমাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানলে “সোনার বাংলা” গানটি আমাদের জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তাই পরিবর্তন আর মূলোৎপাটন এক কথা নয়। একটা অপ্রীতিকর ঘটনার সুযোগে আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হলে তা হবে জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। তাই দেশের কল্যাণে বিভাজিত না হয়ে বর্তমান সরকারকে সময় ও সুযোগ দেওয়া উচিত।
কোনো কিছুর পরিবর্তন করতে চাইলে সময়ই সব বলে দিবে। সকলের সব দায়িত্ব নেওয়া উচিত নয়।ডাক্তারের কাজ ডাক্তারকেই করতে দিতে নয়, নইলে সুরৎহালে যথেষ্ট হেরফের লেগে যেতে পারে। তাই বলবো ডোম দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের সুরৎহাল করে জাতীয় ঐক্য নষ্ট করবেন না প্লিজ।
এম.কন্ঠ/ ০৯ সেপ্টেম্বর /এম.টি