ঢাকা ০২:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

থমকে যেতে পারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক মুকলেসুরের সংসারের চাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ১২:১৪:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আড়াই বছর বয়সে টাইফয়েড জ¦রে দৃষ্টি হারান মো. মুকলেসুর রহমান। দুচোখে পৃথিবী না দেখলেও যানবাহনে ফেরি করে চকলেট বিক্রি করে এসএসসি, বই বিক্রি করে এইচএসসি এবং জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন।

অর্জন করেছেন ১০ম শিক্ষক নিবন্ধের সনদও। তবুও প্রায় এক যুগেও শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় চাকরি পাননি। ২০২৩ সালে টাঙ্গাইল শহরের বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজে খন্ডকালীন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও সম্প্রতি সেই চাকরিও আগামী মাস থেকে থাকছে না। আবার শিক্ষক হয়ে তিনি কারো কাছে হাত পাততে চান না। তাহলে কি থমকে যাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইংরেজি শিক্ষক মুকলেসুর রহমানের সংসারের চাকা!

মো. মুকলেসুর রহমান বলেন, আমার জীবনের ২০ বছর পড়াশোনা ও ১০ বছর চাকরির পেছনে ঘুরেছি। ১০ লাখ টাকা ঘুষ না দেয়ায় আমার চাকরি হয়নি। তাহলেও আমার ৩০ বছরের জীবনের ক্ষতিপূরণ কে দিবে। সরকারের নীতিহীনতা, আইনের অপ্রয়োগ ও ভুল প্রদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কারনে আমাদের চাকরি হচ্ছে না।

তিনি বলেন, আন্দোলনের ফলে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীদের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা প্রতিবন্ধী যারা রয়েছি তারা সব সময় বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ক কোন উপদেষ্টা বা কমিশন নাই। প্রতিবন্ধীদের চরম বৈষম্য দূরীকরনে জন্য প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে একজন করে প্রতিবন্ধী নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধীরা মাস্টার্স শেষ করার সাথে সাথেই যেনো কর্ম পায়।

তিনি আরও বলেন, বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসি) আওতায় সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে সেখানে প্রায় আট বছর যাবত শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না। সেখানেও যদি আমাকে নিয়োগ দিতো তাও অনেক উপকার হতো। আমি জীবনে আর কোন দিন ভিক্ষা করবো না। সামর্থ থাকা সত্বেও ভিক্ষা করা চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক বলেন, ২০২৩ সালে এনটিআরসিএ চতুর্থ গণ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছি। তবে প্রতিদ্বন্ধী হওয়ার সুবাধে সেখানে কোন কোটা না থাকায় আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবে আমি তো বাংলাদেশের নাগরিক। সরকারি আইন যদি আমাদের বিপক্ষে কাজ করে তাহলে আমাদের আর কিছু করার নাই। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে বলা আছে যদি কোন প্রতিবন্ধী কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাকে বাদ দেয়া যাবে না। যদি বাদ দিতে হয় তাহলে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। তাদের পরিবারের কেউ উচ্চ শিক্ষিত নেই। অডিও রেকর্ড করে পড়াশোনা করেছেন।

মো. মুকলেসুর রহমান গাজীপুরের নাগা এলাকার আবুল মনসুরের ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। প্রায় তিন বছর যাবত টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকা মুন্সিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। তার এক মাত্র ছেলে আব্দুল মার্সিফুল তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।

মো. মুকলেসুর রহমান জানান, ১৯৯০ সালে টাইফয়েড জ¦রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হারান। ২০০৩ সালে গাজীপুর বিওএফ হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৫ সালের গাজীপুর ক্যান্টমেন্ট বোর্ড কলেজ থেকে এইচএসসি, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ২০১০ সালে অনার্স ও ২০১১ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। পড়াশোনা করতে ভিক্ষা না করে কখনও যানবাহনে ফেরি করে চকলেট বিক্রি করেছেন। আবার কখনও নিজের লেখা উপন্যাস দম্ভ, ছোট গল্প ও কবিতার বই ক্ষুদ্র মেধার, ক্ষুদ্র প্রয়াস ও আমার জীবনী নামের বই বিক্রি করেছেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বিয়ের পর গাজীপুরে ফেক্সিলোডের দোকানের পাশাপাশি চায়ের দোকান করেছেন।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র প্রদীপ কুমার শীল বলেন, মুকলেসুর রহমান স্যার অনেক ভাল ক্লাশ নেন। তাকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে রাখা জরুরি বলে আমি মনে করি।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, এক জনকে রাখতে হলেও আরও আট জনকে রাখতে হবে। এই আটজনকে রাখতে প্রতিষ্ঠানের মাসে এক লাখ টাকার উপরে খরচ হয়। সেই খরচ কমাতে মুকলেসুরদের বাদ দেয়া হয়েছে। মুকলেসুর যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায় সে জন্য তাকে আরও এক মাস আগে ছুটি দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিলে মুকলেসুর রহমানকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ঘাটতি সরকারি নিয়ম অনুযায়ি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। তাই তার মতো আট জন খন্ডকালীন শিক্ষককে বাদ দেয়া হয়েছে।

এম.কন্ঠ/ ৩১ ডিসেম্বর /এম.টি

নিউজটি শেয়ার করুন

থমকে যেতে পারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক মুকলেসুরের সংসারের চাকা

প্রকাশ: ১২:১৪:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আড়াই বছর বয়সে টাইফয়েড জ¦রে দৃষ্টি হারান মো. মুকলেসুর রহমান। দুচোখে পৃথিবী না দেখলেও যানবাহনে ফেরি করে চকলেট বিক্রি করে এসএসসি, বই বিক্রি করে এইচএসসি এবং জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন।

অর্জন করেছেন ১০ম শিক্ষক নিবন্ধের সনদও। তবুও প্রায় এক যুগেও শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় চাকরি পাননি। ২০২৩ সালে টাঙ্গাইল শহরের বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজে খন্ডকালীন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও সম্প্রতি সেই চাকরিও আগামী মাস থেকে থাকছে না। আবার শিক্ষক হয়ে তিনি কারো কাছে হাত পাততে চান না। তাহলে কি থমকে যাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইংরেজি শিক্ষক মুকলেসুর রহমানের সংসারের চাকা!

মো. মুকলেসুর রহমান বলেন, আমার জীবনের ২০ বছর পড়াশোনা ও ১০ বছর চাকরির পেছনে ঘুরেছি। ১০ লাখ টাকা ঘুষ না দেয়ায় আমার চাকরি হয়নি। তাহলেও আমার ৩০ বছরের জীবনের ক্ষতিপূরণ কে দিবে। সরকারের নীতিহীনতা, আইনের অপ্রয়োগ ও ভুল প্রদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কারনে আমাদের চাকরি হচ্ছে না।

তিনি বলেন, আন্দোলনের ফলে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীদের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা প্রতিবন্ধী যারা রয়েছি তারা সব সময় বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ক কোন উপদেষ্টা বা কমিশন নাই। প্রতিবন্ধীদের চরম বৈষম্য দূরীকরনে জন্য প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে একজন করে প্রতিবন্ধী নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধীরা মাস্টার্স শেষ করার সাথে সাথেই যেনো কর্ম পায়।

তিনি আরও বলেন, বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসি) আওতায় সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে সেখানে প্রায় আট বছর যাবত শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না। সেখানেও যদি আমাকে নিয়োগ দিতো তাও অনেক উপকার হতো। আমি জীবনে আর কোন দিন ভিক্ষা করবো না। সামর্থ থাকা সত্বেও ভিক্ষা করা চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক বলেন, ২০২৩ সালে এনটিআরসিএ চতুর্থ গণ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছি। তবে প্রতিদ্বন্ধী হওয়ার সুবাধে সেখানে কোন কোটা না থাকায় আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবে আমি তো বাংলাদেশের নাগরিক। সরকারি আইন যদি আমাদের বিপক্ষে কাজ করে তাহলে আমাদের আর কিছু করার নাই। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে বলা আছে যদি কোন প্রতিবন্ধী কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাকে বাদ দেয়া যাবে না। যদি বাদ দিতে হয় তাহলে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। তাদের পরিবারের কেউ উচ্চ শিক্ষিত নেই। অডিও রেকর্ড করে পড়াশোনা করেছেন।

মো. মুকলেসুর রহমান গাজীপুরের নাগা এলাকার আবুল মনসুরের ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। প্রায় তিন বছর যাবত টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকা মুন্সিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। তার এক মাত্র ছেলে আব্দুল মার্সিফুল তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।

মো. মুকলেসুর রহমান জানান, ১৯৯০ সালে টাইফয়েড জ¦রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হারান। ২০০৩ সালে গাজীপুর বিওএফ হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৫ সালের গাজীপুর ক্যান্টমেন্ট বোর্ড কলেজ থেকে এইচএসসি, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ২০১০ সালে অনার্স ও ২০১১ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। পড়াশোনা করতে ভিক্ষা না করে কখনও যানবাহনে ফেরি করে চকলেট বিক্রি করেছেন। আবার কখনও নিজের লেখা উপন্যাস দম্ভ, ছোট গল্প ও কবিতার বই ক্ষুদ্র মেধার, ক্ষুদ্র প্রয়াস ও আমার জীবনী নামের বই বিক্রি করেছেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বিয়ের পর গাজীপুরে ফেক্সিলোডের দোকানের পাশাপাশি চায়ের দোকান করেছেন।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র প্রদীপ কুমার শীল বলেন, মুকলেসুর রহমান স্যার অনেক ভাল ক্লাশ নেন। তাকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে রাখা জরুরি বলে আমি মনে করি।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, এক জনকে রাখতে হলেও আরও আট জনকে রাখতে হবে। এই আটজনকে রাখতে প্রতিষ্ঠানের মাসে এক লাখ টাকার উপরে খরচ হয়। সেই খরচ কমাতে মুকলেসুরদের বাদ দেয়া হয়েছে। মুকলেসুর যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায় সে জন্য তাকে আরও এক মাস আগে ছুটি দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিলে মুকলেসুর রহমানকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

বিবেকানন্দ হাইস্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ঘাটতি সরকারি নিয়ম অনুযায়ি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। তাই তার মতো আট জন খন্ডকালীন শিক্ষককে বাদ দেয়া হয়েছে।

এম.কন্ঠ/ ৩১ ডিসেম্বর /এম.টি