রুহুল আমিন: যে আছে জাগ্রত হৃদয়ে
মানুষ যায়, তাকে চলে যেতেই হয়। কেননা জীবনে মৃত্যু একটি পরম সত্য। মহান স্রষ্টার ডাক এলে পৃথিবীর কোনো সাধ্য নেই তাকে আটকায়। তবুও কিছু মানুষের চলে যাওয়া মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। তরুণ সাংবাদিক মীর রুহুল আমিনের চলে যাওয়াটা ছিল সেরকমই। ২০০৮ সালের ১৯ মে ভোররাতে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল সে। আজ ১৬ বছর হয়ে গেল, তবুও বিশ্বাসই হতে চায় না, রুহুল আর নেই।
রুহুল ছিল একাধারে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মী; আমার সাংবাদিকতা জীবনে রিপোর্টিংয়ের কলাকৌশলের অনেকটাই শিখেছি ওর হাত ধরে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যÑ এই সুদীর্ঘ ১৮ বছরের সুগভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে রুহুলকে যতটুকু জেনেছি ও দেখেছি, তাতে ওর মতো এত শান্ত, শিষ্ট, নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ খুব কমই চোখে পড়েছে আমার। সর্বক্ষণ তার মুখজুড়ে ফুটে থাকতো হাসি। কারও সাথে ঝগড়া দূরে থাক, কখনও উচ্চবাচ্যে কথা বলতে দেখিনি তাকে।
আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম সাতজন। বন্ধুত্ব ও বন্ধনের সুদীর্ঘ পথে আমাদের অন্যান্য বন্ধুর মধ্যে কথা কাটাকাটি বা মান-অভিমান হয়েছেন দু’চারবার, কিন্তু রুহলের সাথে আমাদের কারোরই এমনটা হয়নি কখনো। অনেক সময় ইচ্ছে করে ওর সাথে খুনসুটি বাঁধানোর চেষ্টা করেছি আমরা। ও বুঝতে পেরে বলতো, ‘দোস্ত, এই পিঠ পেতে দিলাম, আমাকে মেরে যত পারিস মজা লুটে নে, কিন্তু দোহাই লাগে, তোদের সাথে মান-অভিমানের খেলা খেলতে পারব না আমি; অভিমান করে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে রে।’ আসলে রুহুল আমিনের মনটা ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ভালোবাসতে জানতো বলেই ৩২ বৎসরের জীবদ্দশায় জয় করে নিতে পেরেছিল অসংখ্য মানুষের মন।
মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত রুহুল আমিনের সাংবাদিকতার বয়স ছিল ১৪ বছর। অসাধারণ মেধা, প্রতিভা, দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠাগুণে এই সময়ের মধ্যেই টাঙ্গাইলে সাংবাদিকতায় একটা সুদৃঢ় অবস্থান করে নিয়েছিল সে। সাংবাদিক হতে গেলে কতটা নির্ভীক হতে হয়, কতটুকু দায়িত্ববোধ থাকতে হয়, রুহুল ছিল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সাংবাদিকতা যে একজন মানুষের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা হতে পারে, তার মধ্যে তা না দেখলে বিশ্বাসই হতো না কখনো। অথচ সাংবাদিকতায় তার আগমন ছিল নিছকই সখের বসে।
১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস, এক বৈকালিক আড্ডায় আমরা ছয় বন্ধু মিলে ভাবলাম একটা ক্লাব গঠন করলে কেমন হয়? নামকরণ করা হলো ‘বন্ধু জাগরণী’ ক্লাব। ক্লাবের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে আদি টাঙ্গাইল তরুণ একাদশের সাথে প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হলো। আমাদের আরেক বন্ধু মোজাম্মেল হক জানালো, ‘খেলার খবরটি পত্রিকায় ছাপানো যাবে।’ মোজাম্মেল তখন দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার। রুহুল আমিনের অতি আগ্রহে খেলার তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে রুহুলের ওপর। রুহুল পত্রিকার খেলার পাতার একজন মনোযোগী পাঠক ছিল। তাই সেই আদলে খুব সহজেই খেলার খবরটি লিখে ফেলে সে। মোজাম্মেল-এর সহযোগিতায় ‘দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এ বি এম সালাহউদ্দিন ভাইকে (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) খবরটি দেখালে তিনি পড়ে মুগ্ধ হন এবং জানান, ‘আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের পত্রিকায় স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে পারেন। প্রস্তাব শুনে রুহুল যেন চাঁদ হাতে পায়, আগুপিছু না ভেবে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। আগ্রহ, মেধা ও প্রতিভাগুণে সম্পাদকের সহযোগিতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য রিপোর্টিংয়েও পারদর্শী হয়ে ওঠে। এভাবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে রুহল। ১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক সোনালী বার্তা’-এর জেলা প্রতিনিধি হয়।
১৯৯৯ সালে ‘দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে। ২০০০ সালে মুহাম্মদ আব্দুর রকীব (ভাই) সম্পাদিত টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক মফস্বল’-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘দৈনিক সোনালী বার্তা’ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে খুবই মুষড়ে পড়ে রুহুল; প্রিয়জনের মৃত্যুতেও মানুষ এতটা ভেঙে পড়ে কিনা, জানা নেই। শোকে-দুঃখে সাংবাদিকতাই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ছাড়তে পারেনি এই পেশার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠায়। এরপর যাথাক্রমে ‘দৈনিক গণজাগরণ’, ‘দৈনিক আজাকালের খবর’, ‘দৈনিক সোনার আলো’, ‘সাপ্তাহিক স্পোর্টস লাইন’ পত্রিকায়ও জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছে। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘দৈনিক নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করে সে।
‘দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম’, ‘দৈনিক মফস্বল’ ও ‘দৈনিক নয়াদিগন্ত’Ñ একসাথে তিনটি পত্রিকার গুরুদায়িত্ব পালন করা সহজ নয়, পরিশ্রমও কম নয়। প্রতিদিন সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত বিরামহীন পরিশ্রম করতে হয়েছে, তবে রুহুল আমিনের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখিনি কখনো, দেখিনি বিরক্তি। পত্রিকায় শত ব্যস্ততা থাকার পরও তার সাংগঠনিক তৎপরতাও চলতো সমান তালে। অনেক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সে, কোনো কোনোটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিল, যেমনÑ টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে একাধারে তিন টার্ম ক্রীড়া সম্পাদক, জেলা ক্রীড়া লেখক সমিতির সভাপতি, ফুলকুড়ি টাঙ্গাইল শাখার উপদেষ্টা, এনজিও পশষিক পর্ষদ-এর নির্বাহী কমিটির সদস্য, এনজিও ফর দ্য চিলড্রেন-এর সাংগঠনিক সম্পাদক, রেডক্রিসেন্ট টাঙ্গাইল-এর উপকমিশনার, বাংলাদেশ স্কাউটস টাঙ্গাইলের উপকমিশনার ইত্যাদি।
রুহুল আমিন-এর জন্ম ১৯৭৬ সালের ৭ মে টাঙ্গাইল শহরস্থ বেপারীপাড়ায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রুহুল ছিল সবার বড়। তাই পরিবারের অভাব ঘোচানোর অনেকটা দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। পারিবারিক চাহিদা আর উপার্জনের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে তাকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়েছে। তাই শিক্ষা জীবনের ধারাবাহিকতাতেও ছেদ ঘটে। টাঙ্গাইল শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে এসএসসি, সরকারি এম এম আলী কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাস করে। একই কলেজ থেকে ২০০০ সালে বিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেয়। অভাব তাকে সততা ও ন্যয়নীতির আদর্শ থেকে নাড়াতে পারেনি। সত্য-মিথ্যার মিশেলে চটকদার সংবাদ লিখে রাতারাতি খ্যাতি অর্জনের লোভ তার মধ্যে ছিল না।
রুহুলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ওকে দেখতে অসংখ্য মানুষের ঢল নেমেছিল হাসপাতালে ও বাড়িতে। জানাজায়ও শরিক হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ওকে নিয়ে এত শোকসভা ও দোয়া মাহফিল হয়েছে যে, অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুতেও তা দেখিনি। যেদিন ভোরে রুহুল মারা যায়, তার দুই দিন পর ওর বিয়ের দিনক্ষণ পাকাপাকি হওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে ১৮ মে আরেক বন্ধু জাকিরের স্টেশনারিতে বসে আমাদের মধ্যে কত হাসি-ঠাট্টাÑ বিয়েতে কাকে দাওয়াত করা হবে, বরযাত্রায় কে কে যাবে ইত্যাদি নিয়ে কত কথা বলেছি। তখনো ভাবিনি বরযাত্রা নয়, প্রচণ্ড ব্যথা বুকে চেপে অঝোরে অশ্রুপাত করতে করতে তার লাশ কাঁধে বয়ে নিয়ে আমরা হব তার শবযাত্রার সঙ্গী।
ওইদিন ভোর পৌনে পাঁচটা। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। রিসিভ করতেই আতিক মামার (দৈনিক আজকের টেলিগ্রাম পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক আতিকুর রহমান) কন্ঠ, ‘মঈন, এখনই সদর হাসপাতালে চলে এসো, রুহুলের অবস্থা খুবই খারাপ, ওকে হাসপাতালে আনা হয়েছে।’ ঝটপট উঠে মুখটা ধুয়েমুছে প্যান্টটা পরেছি মাত্র। আবার আতিক মামার ফোন, ‘মঈন, রুহুল আর নেই, ও মারা গেছে।’ শুনে এতটা হোচট খেলাম, কখন যে হাত থেকে মেবাইল ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেছে, টেরই পাইনি। সম্বিত পেয়ে কষ্ট আর কান্না চেপে ঢাকাস্থ বন্ধু রাশেদকে কল করলাম, ‘রাশেদ, তোর আজকের সকল কাজের শিডিউল বন্ধ রাখ, রুহুলকে শেষ দেখা দেখতে চলে আয়।’ রাশেদ সংবাদটা বিশ্বাস করতে পারল না, সে তার স্বভাবসুলভ গালি দিয়ে বসলো আমাকে। কেঁদে উঠে বললাম, ‘পরে ইচ্ছেমত বকিস, রুহুল সত্যিই নেই।’ রাশেদের কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনতে শুনতে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে জাকিরকে ফোনে রুহুলের মৃত্যু খবর জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাঝপথে জাকিরকে রিকশায় তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতেই আতিক মামা লাশ দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে রুহুল।’
ট্রলিতে শুয়ে আছে রুহুল। ওর চির ঘুমন্ত মুখটা যেন হাসছে। মনেই হচ্ছিল না মৃতদেহ ওটা। মনে হচ্ছিল সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর মানুষ নিশ্চিন্তে-নির্ভয়ে যেভাবে ঘুমায়, রুহুল সেভাবে ঘুমিয়ে আছে, যেন সে একটু পরই জেগে উঠবে। কিন্তু চিরনিদ্রায় চলে গেলে কেউ কি জেগে ওঠে? ভেজা চোখে অনেকক্ষণ ওর মুখটা দেখলাম। ঘাতক বিদ্যুৎ তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। মৃত্যুর পথ ধরে সে চলে গেছে অন্য জগতে। শত ডাকলেও সে আর আমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। বলবে না, ‘তোদের সাথে মান-অভিমান করে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে রে।’ জানবেও না কোনোদিন, ওর শূন্যতা কী ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে আমাদের। তাকে হারিয়ে যে ব্যথা আজও আমরা পাচ্ছি, তা প্রকাশের ভাষা জানা নেই। দোয়া করি, মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত দান করুন।
এম.কন্ঠ/ ১৯ মে /এম.টি