মসজিদ দূরে হলে সওয়াব বেশি কেন
অধিকাংশ মুসলমানেরই প্রত্যাশা থাকে মসজিদ যেন ঘরের কাছে হয়। এতে আজানের মধুর সূর শুনতে শুনতে মসজিদে উপস্থিত হওয়া যাবে। কিন্তু দুর্গম এলাকায়, বিশেষ করে পাহাড়-পর্বত ও নদীপাড়ের অনেক মানুষের ঘর হয় মসজিদ থেকে দূরে। ফলে ওসব মুসলিমকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মসজিদে উপস্থিত হতে বহুদূর পাড়ি দিতে হয়।
হাদিস বলছে, তাদের আশাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং তাদের জন্য রয়েছে নবীজির সুসংবাদ। ঘরবাড়ি মসজিদ থেকে দূরে হলে দূরত্ব অনুযায়ী সওয়াব অনেক বেড়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে অজু করে আল্লাহর কোনো ঘরের দিকে এই উদ্দেশ্যে যাত্রা করে যে আল্লাহর নির্ধারিত কোনো ফরজ ইবাদত (সালাত) আদায় করবে, তাহলে তার প্রতি দুই পদক্ষেপের মধ্যে একটিতে একটি করে গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং অন্যটিতে একটি করে মর্যাদা উন্নত করা হবে। (মুসলিম: ১৪০৭)
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রা.) বলেন, এক আনসারি সাহাবির মৃত্যু উপস্থিত হলে তিনি বলেন, আমি তোমাদের কাছে একটি হাদিস শুধু সওয়াব অর্জনের জন্য বর্ণনা করতে চাই। আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন ভালোভাবে অজু করে সালাতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, তখন সে তার ডান পা ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তার আমলনামায় একটি নেকি লেখা হয়। অতঃপর তার বাঁ পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তার একটি গুনাহ মাফ করা হয়। অতএব, ব্যক্তি ইচ্ছা করে তার আবাসস্থল মসজিদের কাছে বা দূরে করতে পারে। অতঃপর ওই ব্যক্তি মসজিদে আগমনের পর জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় করলে তার সব (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। যদি সে মসজিদে পৌঁছতে পৌঁছতে তারা কিছু অংশ আদায় করে ফেলে এবং কিছু বাকি থাকে, তাহলে সে ইমামের সঙ্গে যতটুকু পাবে ততটুকু আদায় করবে এবং যা বাকি থাকবে তা পূর্ণ করবে। কিন্তু সওয়াবের ব্যাপারে ওই ব্যক্তি পূর্ণ সালাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতো হবে। যদি সে মসজিদে আসার পর দেখে যে ইমাম তাঁর সালাত শেষ করে ফেলেছেন, তখন সে একাকী সালাত আদায় করবে। তবু তাকে ক্ষমা করা হবে। (আবু দাউদ: ৫৬৩)
উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, এক (আনসারি) লোক ছিলেন। মসজিদ থেকে তার চেয়ে দূরে কোনো ব্যক্তি অবস্থান করতেন বলে আমার জানা নেই। তবু তিনি কোনো ওয়াক্ত সালাত (জামাতে মসজিদে) আদায় করতে ত্রুটি করতেন না। একদা তাকে বলা হলো বা আমি তাকে বললাম, যদি একটা গাধা ক্রয় করতেন এবং রাতের অন্ধকারে ও উত্তপ্ত রাস্তায় তার উপর আরোহণ করতেন (তাহলে ভালো হতো)! তিনি বলেন, আমার বাসস্থান মসজিদের পাশে হলেও তা আমাকে আনন্দ দিতে পারত না। কারণ আমার মনস্কামনা এই যে মসজিদে যাওয়ার এবং নিজ বাড়ি ফেরার সময় প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে যেন সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) (তার এমন নেকি অর্জনের আগ্রহ দেখে) বলেন, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) তার সব জুটিয়েছেন। (মুসলিম: ১৪০০)
উল্লেখিত হাদিসগুলোতে দেখা যাচ্ছে, দূরের মসজিদে হেঁটে গেলে প্রতি কদমে কদমে সওয়াব ও মর্যাদা লাভ হয়। দূরত্ব বেশি হলে স্বাভাবিকভাবে কদমের সংখ্যাও বেড়ে যায়। তাই দূরত্ব অনুযায়ী সওয়াবও বেশি হয়। এর অন্যতম কারণ হতে পারে- বান্দা আল্লাহর ইবাদতের জন্য বেশি কষ্ট করার কারণে আল্লাহ তাআলা খুশি হয়ে বেশি সওয়াব দিচ্ছেন। তাইতো নবী (স.) আয়েশা (রা.)-কে বলেছেন- إن لك من الأجر على قدر نصبك ونفقتك ‘নিশ্চয় তোমার শ্রম ও ব্যয়ের পরিমাণ অনুযায়ী তুমি সওয়াব পাবে।’ (সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ১১১৬)
যেমন- রোজা ও হজ কষ্টকর আমল হওয়ার কারণে অনেক বেশি সওয়াব লাভ হয়। রাতে ঘুম ভেঙে উঠে তাহাজ্জুদ পড়া কষ্টকর হওয়ায় ফজিলতও অনেক বেশি। একইভাবে ফজরের নামাজ কষ্টকর হওয়ার কারণে গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে কম কষ্টকর আমলের সওয়াব বেশি কষ্টকর আমলের চেয়ে বেশি হতে পারে। যেমন- জামায়াতের সাথে ১ বার নামাজ আদায় করা একাকী ২৫ বার নামাজ আদায় করা থেকে উত্তম।
এছাড়াও দূরের মসজিদে জামাতে শরিক হওয়ার জন্য কষ্ট করে দূরে হেঁটে যাওয়া নিঃসন্দেহে তাকওয়ার আলামত। আর আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার মানদণ্ড হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘…তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদার অধিকারী যে বেশি তাকওয়ার অধিকারী। আল্লাহ সবকিছু জানেন। সব খবর রাখেন। (সুরা হুজরাত: ১৩)
উল্লেখ্য, কাছে মসজিদ থাকলে বিনা কারণে দূরের মসজিদে যাওয়া উচিত নয়। তবে কাছের মসজিদের ইমামের কেরাত ভালো না হলে এবং রুকু-সেজদা ঠিকভাবে আদায় না করলে দূরের মসজিদে যেতে দোষ নেই। এছাড়াও কাছের ইমামের বিদআতি আমল অথবা প্রকাশ্য ফাসেকি কাজের কারণে দূরের মসজিদে ভালো ইমামের পেছনে নামাজ পড়তে যাওয়া দোষণীয় নয়। আর দূরের মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্য যদি হয় কদমে কদমে সওয়াব হাসিল, তাহলে তাও একটি মহৎ কাজ।